শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

কেপিসি, তোমার সাথে আমার দিনগুলো

কর্মমুখর এখনকার দিন গুলি খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়, সূর্যাস্ত বেশ কয়েক বছর হল দেখা হয়নি; সূর্যের আলোকেও ভালো মত অনুভব করতে পানি না সময়ের অভাবে। তবুও মনকে তো আর আটকে রাখতে পারিনা, সে তো ছুটে বেড়ায় প্রতিনিয়ত; টেনে হিচড়ে বের করে তার মধ্য লুকিয়ে থাকা সব স্মৃতির ভান্ডার থেকে সব চিন্ময় ঘটনা গুলোকে। অনেক ঘটনা গুলো মরিচায় আচ্ছন্ন, আর কিছু কিছু ঘটনা স্বর্ণালী চাকচিক্য সহকারে মনের জানালায় উঁকি দেয়। আর যখন পরিসংখ্যানে বসি স্বর্ণালী এই স্মৃতি গুলোকে নিয়ে, একটাই পরিচয় পাই- এইতো সেদিনের সেই পাবলিক কলেজের দিন গুলি।১০ বৎসর হয়ে গেল প্রায়; কিন্তু আজও মনে হয় বেশী দিন আগের কথা নয়।

ক্ষুদ্র এই জীবনে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদচারনার সুযোগ হয়েছে। তার মধ্য পাবলিক কলেজের আমার ব্যপ্তিকালটি অপেক্ষাকৃত কম সময়ের কারণ আমি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম একাদশ শ্রেনীতে; আর এজন্য আমার আপশোষ একটুও কম নয়!!! কেন আরো আগে তোমার কাছে যাইনি আমি, কেপিসি?

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পরই কলেজে ভর্তির জন্য ছুটাছুটি। হারাতে মন চাইছিল না ছোটবেলা থেকে একসাথে বেড়ে উঠা সব বন্ধুদের, ইচ্ছা ছিল ওদের সাথেই কোন এক কলেজে ভর্তি হব। কিন্তু আমার প্রগতিশীল ও সচেতন বাবার ইচ্ছা আমাকে এমন একটি কলেজে ভর্তি করা যেখানে আমি শুধু মাত্র একজন ভালো ছাত্র না, পাশাপাশি একজন আদর্শ মানুষ হয়ে উঠি। তিনি কখনই চাননি যে বেড়ে উঠার সেই বয়সে কোন অবস্থাতেই আমি প্রচলিত নোংরা ছাত্র রাজনীতিতে জড়াই। বিকল্পহীন কেপিসি থেকেই ভর্তি ফরম তুলে আনেন আমার বাবা। আমার ইচ্ছা ছিল না ওখানে ভর্তি হবার; রাগ করে কোন প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম না।

কেপিসি'র প্রথম সাক্ষাত সেই ভর্তি পরীক্ষাতে। সেদিনই আমি মুগ্ধ তোমাতে। জানি না কেন? কিন্তু পরীক্ষা শেষ হবার পর মুহূর্ত থেকে একটাই কামনা ছিল, কেপিসি যেন আমাকে নিরাশ না করে। আমাকে নিরাশ করেনি। ভর্তিও হলাম। বাবার সিদ্বান্ত বান্ধব ও আত্মীয়হীন খুলনাতে থাকতে হলে আমাকে হোস্টলেই থাকতে হবে। তার জন্য আলাদা করে ইন্টারভিউ। তখন আর আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি, কারণ আমি তখন কেপিসি'র ভালোলাগায় মত্ত। আর সেই ইন্টারভিউ বোর্ডেই প্রথম সাক্ষাৎ আমার কলেজ জীবনের সব থেকে প্রিয় শিক্ষক বেনিয়াজ জামান স্যারের। হাউজের সিট বরাদ্দ করা হয়েছিল সেপ্টেম্বর থেকে, কিন্তু ক্লাস শুরু হয়েছিল আগষ্টের মাঝামাঝি সময়ে। কলেজের প্রথম দিনটিতে হাজির না হলেই নয় যদিও সকাল ৮ টার মধ্যে আমার বাড়ী থেকে খুলনাতে হাজির হওয়া খুবই কষ্টের। বিপদ আরো বেড়ে গিয়েছিল কোন এক রাজনৈতিক নেতার নিহত করবার কারনে। সেদিন খুলনাতে হরতাল ডাকা হয়। শত অসুবিধার মধ্যেও আমি কেপিসিকে হারাতে চাইনি একটি দিনের জন্যও। শত কষ্ট উপেক্ষা করে বাবা আমাকে সেদিন পৌছে দিয়েছিল তোমার দাড় প্রান্তে।
প্রথম ক্লাসটি ছিল বাংলার অধ্যাপক হারুন স্যার এর; সেটি কেটে গেল নিজের রোল নং জানতে জানতে। তার পর আসলেন বেনিয়াজ জামান স্যার। উনি আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন। সবাইকে নিজ নিজ পরিচয় দিতে হচ্ছিল; আমি পরিচয় দেওয়া শুরু করা মাত্র স্যার আমাকে আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, তোমার হাউজে সিট দেওয়া হয়েছে। স্যারের মুখে আমার নাম উচ্চারণের সাবলীলতা দেখেই মনে হয়ছিল, স্যারের সাথে আমার সময়গুলো খুবই ভালো যাবে।

বাড়ী ছেড়ে হাউজের আসার সময় টা আমার মনকে এখনও আদ্র করে তোলে; মনে পড়ে মা'র অশ্রুসজল চোখ। আমি ছিলাম একটি নতুন অভিজ্ঞতা ও সাময়িক পরিবার থেকে দূরে থাকবার মধ্যবর্তী অনুভবের মাঝখানে। আমাদের নতুন ভর্তি হওয়া ছ'জন বিজ্ঞানের ছাত্রকে দেয়া হয়েছিল ১ নং রুমে। আমি খুব সমস্যা পড়েছিলাম সবার নাম মুখস্ত করতে। তখন হোস্টলে শতাধিক ছাত্র থাকতো, একবারে অত: গুলো নতুন নাম মনে রাখবার চেষ্টা করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। প্রায়ই মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলতাম নাম গুলো। প্রথম সপ্তাহ চলে গিয়েছিল হাউজের ঘন্টার কোড বুঝতে আর তার সাথে কোন কাজ কি ভাবে করতে হবে সেটা জানতে। খুব কষ্ট হত প্রথম প্রথম। সকালে সেই নামাজের ঘন্টা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর ঘন্টা পর্যন্ত। ফাঁকি দেবার কোন উপায় ছিল না প্রিফেক্ট দের জন্য। খুব রাগ হত ওই সব ক্ষমতাধর(!) ছেলে গুলোর জন্য। রাতে খাবার পর দুশ্চিন্তা সহকারে আগ্রহে থাকতাম নিজের নামটা ডাক পড়বে কিনা কারণদর্শানোর জন্য।

কিছু দিন পরই নতুন বছরের জন্য নতুন প্রিফেক্টিয়াল বোর্ডের নাম ঘোষনা হল নবীন বরনের জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। জানতাম না কে কে হবে নতুন প্রিফেক্ট। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নতুনদের মধ্য থেকে আমার নামটি উচ্চারিত হয়েছিল। সম্বিত ফিরে আসলে জানলাম, সাংস্কৃতিক প্রিফেক্ট হিসাবে আমি মনোনীত হয়েছি। অনেকেই খুশী হয়েছিল আমাকে পেয়ে। সাথে সাথে আরেকটি নৈমত্তিক দায়িত্ত্ব যোগ হয়েছিল, মাগররিবের আযানের পর সারাদিনের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবার।অনেকটা আইনের রক্ষকের মত আচরণ করতে হত। এসবের মাঝেও দুষ্টমীর জন্য ছোটখাটো কিছু অপরাধও করেছি, যদিও সেগুলো খুবই কম লোক জানে। বিকালে খেলার সময়ে মাঝে মাঝে খেলা ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম ফুলের বাগান থেকে ফুল চুরি করতে। এক্ষেত্রে আমাদের ৩ সদস্যবিশিষ্ট দল ছিল; যাদের মধ্যে ১ জনের কাজ ছিল তার আকস্মিক ও সন্দেহ জনক আচরণ দিয়ে মালীকে দিশেহারা করে তোলা, আর বাকীরা সেই সুযোগে ফুল চুরি করা। জানতাম এটা অন্যায় তবে তখন এটা করেই ঐ বন্দীদশার মধ্য আনন্দ খুঁজতাম।

একবার কোন এক ছুটির দিনে বেনিয়াজ স্যারের নির্দেশে আকস্মিক ভাবে নেমে পড়লাম এক নাটক মঞ্চস্থ করবার কাজে। সেটা ছিল সাংস্কৃতিক প্রিফেক্ট হিসাবে আমার প্রথম কোন কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই মিলে প্রস্তুতি সেড়ে রাতের খাবারের পরই মঞ্চায়ণ। রবীন্দ্রনাথের 'মুকুট'। এখনও আমি মনে করি সেদিনের সেই নাটক যেই দেখুক না কেন, কেউ বলবে না ওটা আমাদের প্রথম মঞ্চায়ন ছিল। সবার মধ্য চিল একাত্ম হয়ে যাবার তীব্র আকাংখা, নিজেকে অন্যর জন্য বিলিয়ে দেবার বাসনা। সব সময়ই নিজেদের মধ্য চলত সুপ্ত প্রতিযোগীতা। সেটা রাতের খাবারের সময় খাবার টেবিল পরিস্কার করবার প্রতিযোগীতার মধ্যও ফুটে উঠত। সেই সব দিন গুলোতে কখনও মনে হত না আমরা ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে ওখানে হাজির হয়েছি। সকলে মিলে যেন আমরা নিজেরাই এক পরিবার। সেই সব সৌভ্রাতৃত্ত্বময় সম্পর্ক শুধু ওখানেই থেমে থাকেনি; আজও চলছে আরো বেশী গুনে, চলবে সহস্র মুহুর্ত।

যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্টানে আমি যাদের সাথে পড়াশোনা করেছি, কেপিসি বাদে সবখানেই সহপাঠীদের মধ্য সম্পর্কের রকমফের থাকে। কাউকে কাউকে আমরা বন্ধু বলে মেনে নিই, আর বাকী সবাই কে সহপাঠী পরিচয় দিয়েই ক্ষান্ত হয়। কিন্তু কেপিসির শ্রেনীবন্ধুদের আমার কখনই সহপাঠী মনে হয়নি। তাদেরকে সব সময় মনে হয়েছে পাঠবন্ধু।সকলের সাথে সকল ছাত্রের যে সুসম্পর্ক সেটা অন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্টানে আছে কিনা সেটা আমার সন্দেহ, থাকলেও হয়ত কেপিসি'স সাথে তুলনীয় নয়।

বুধবারের শ্রেনী শিক্ষকের সাপ্তাহিক ক্লাস আর পাক্ষিক সমাবেশ সহয়তা করেছে আমাদের ব্যক্তিত্ত, নেতৃত্ত্ব, অন্তশ্রেনী সম্পর্ক, আন্ত:শ্রেনী সম্পর্ক, দলীয় শৃঙ্খলা আর প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়াতে। পড়া শোনার পাশাপাশি যে বৈশিষ্ঠ্য গুলো না থাকলে নতুন শতাব্দীর সাথে তাল মিলিয়ে চলা অসম্ভব, কেপিসি তার ব্যবস্থা করেছে অনেক আগে। কেপিসি'র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা তাকে হেয় করা ছাড়া আর কিছুই নয়; আমার সে দু:সাহসও নেই। শুধু আমার মন বলে, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

নিবেদিত‌প্রাণ অভিজ্ঞ শিক্ষকগন সন্তান স্নেহে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে রেখে যে ভাবে আমাদের গড়ে তুলেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সেটা অনুভব করি। গর্ববোধ করি এটা ভেবে, আমি তোমার কাছে ঠাঁই পেয়েছিলাম এটা ভেবে। প্রতিটি শিক্ষকের মুখ মন্ডল আজও স্পষ্ট আমার হৃদয় আঙিনায় তাদের আশীর্বাদ পুষ্ট মায়াবী মুখশ্রীর কারণে। প্রতিটি ক্ষণ তারা বিলিয়েছে আমাদের মাঝে। কী ভাবে ভুলি তাদের নি:স্বার্থ ও সার্থক জীবন তৈরীর ব্রত। আর এসবের সব কিছুতে রয়েছে একজনই; সে কেপিসি।


--
লেখাটি কেপিসি'র ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরনিকাতে প্রকাশিত হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই: